Clock


Button

Home

Sunday, February 21, 2016

শহিদ মিনার


বাংলাদেশের ভাষা-আন্দোলন (বাংলা) স্মরণে সৃষ্ট স্মৃতিস্তম্ভ।

যে কোনো মহৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে গিয়ে প্রতিপক্ষের আক্রমণে নিহত হলে, নিহত ব্যক্তি শহিদ নামে অভিহিত হয়ে থাকেন। এই অর্থে যে কোনো শহিদের উদ্দেশ্যে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভই শহিদ-মিনার নামে অভিহিত হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে শহিদ মিনার বলতেই ভাষা-শহিদদের উদ্দেশ্যে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভকেই বুঝায়। শহিদ মিনারের আদর্শ রূপটি স্থাপিত হয়েছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ সংলগ্ন একটি খোলা প্রাঙ্গনে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভাষা-শহিদদের উদ্দেশ্যে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভকেও শহিদ-মিনার বলা হয় এবং এর আকৃতি বর্তমান ঢাকায় অবস্থিত শহিদ-মিনার-এর মতই করা হয়
১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখে ঢাকা মেডিকেল কলেজ-ফটকের সামনে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ছাত্র-জনতা বিক্ষোভ মিছিল বের করে। এই বিক্ষোভ প্রতিহত করার জন্য তদানীন্তন পাকিস্তানি পুলিশ ১৪৪ ধারা ারি করে। আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার উপর পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে আবুল বরকত, আব্দুল জব্বার, আব্দুস সালাম, রফিকউদ্দীন আহমদ শহিদ হন এবং প্রায় ৩০০জন আহত হন। এই সময় পুলিশ গ্রেফতার করে ১৮০ জন আন্দোলনকারীকে। ২২শে ফেব্রুয়ারিতেও পুলিশ ঢাকার বিভিন্নস্থানে পুলিশের গুলিতে জন নিহত ১৫০ জন আহত হয়।

২৩শে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা এই ভাষা-শহিদদের স্মরণে তৎকালীন ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা শুরু করে। শেষ হয় ২৪ তারিখ ভোরে। এই স্মৃতিস্তম্ভটি তৈরি করা হয়েছিল বর্তমান শহিদ মিনারের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে (বার তের সংখ্যক ব্যারাকের মাঝামাঝি স্থানে), শহিদদের রক্তভেজা স্থানের উপর। এই স্মৃতিস্তম্ভটি স্থাপন করা হয়েছিল সাড়ে ১০ফুট উঁচু এবং ফুট প্রশস্ত একটি বেদীর উপর। উদ্দেশ্য ছিল যাতে বাইরের রাস্তা থেকে সহজেই দেখা যায় এবং যেকোনো ছাউনি থেকে বেরিয়ে এসে ভেতরের লম্বা টানা রাস্তাতে দাঁড়লেই যেন চোখে পড়ে। মিনার তৈরির তদারকিতে ছিলেন জিএস শরফুদ্দিন (ইঞ্জিনিয়ার শরফুদ্দিন নামে পরিচিত), নকশা অঙ্কন করেছিলেন বদরুল আলম। তাঁদের সাথে ছিলেন সাঈদ হায়দার। শহীদ মিনার নির্মাণে সহযোগিতা করেন দুইজন রাজমিস্ত্রী। মেডিক্যাল কলেজের সম্প্রসারণের জন্য জমিয়ে রাখা ইট, বালু এবং পুরনো ঢাকার পিয়ারু সর্দারের গুদাম থেকে সিমেন্ট এনে নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। ভোর হবার পর একটি কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় মিনারটি। ২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে শহিদ শফিউর রহমানের পিতা এই স্মৃতিস্তম্ভটির প্রারম্ভিক-উদ্বোধন করেছিলেন। তাতে একটি হাতে লেখা কাগজ গেঁথে দেয়া হয়, যাতে লেখা ছিল শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। এই স্মৃতিস্তম্ভটিই ছিল প্রথম শহিদ-মিনার।

১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বাঙালিরা ২১শে ফেব্রুয়ারিকে 'শহিদ দিবস' হিসাবে পালন করা শুরু করে। এবং ভেঙে ফেলা 'শহিদ-মিনার'-এর জায়গায় লাল কাগজে তৈরি একটি শহিদ মিনার তৈরি করে। এই প্রতীকী শহিদ-মিনারে এই বৎসর থেকে প্রভাত ফেরি চালু হয়।

১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে এপ্রিলে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করে। এদের একুশ দফা প্রতিশ্রুতি অনুসারে শহিদ মিনার তৈরির ঘোষণা দেয়। কিন্তু ৩০ মে তারিখে এই সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায়, শহিদ-মিনার তৈরির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।

১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে দ্বিতীয়বার শহিদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। এই ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন তৎকালীন মূখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানী এবং হাসিনা বেগম (ভাষা-শহিদ আবুল বরকত-এর মা) এই সরকারের আমলেই প্রথম 'শহিদ দিবস'-কে সরকারি ছুটির দিন হিসাবে ঘোষণা দেওয়া হয়।

১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময় শহিদ মিনার তৈরির কাজ শুরু হয়। নভেম্বর মাসে শিল্পী হামিদুর রহমানের পরিকল্পনা নকশা অনুসারে নতুন শহিদ মিনার তৈরির কাজ শুরু হয়। তাঁর সহকারী ছিলেন ভাস্কর নভেরা আহমদ। এই নকশাতে শহিদ মিনারকে একটি নান্দনিক রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল শিল্পীদের পরিকল্পনায় ছিল
  • মূল অংশের মঞ্চের উপর দাঁড়ানো মা শহিদদের প্রতীক হিসাবে  থাকবে অর্থবৃত্তাকার স্তম্ভ
  • স্তম্ভের গায়ে থাকবে হলুদ গাঢ় নীল বর্ণের কাঁচ দিয়ে নির্মিত অনেকগুলো চোখের প্রতীক, এই চোখে থেকে প্রতিফলিত সূর্যের আলো একটি বর্ণাঢ্য পরিবেশ তৈরি করবে
  • মিনারের সামনে থাকবে বাংলা বর্ণামালা খচিত একটি রেলিং
  • মিনার চত্ত্বরে থাকবে সংগ্রামী শুভ বিরুদ্ধ অশুভ শক্তির প্রতীক হিসাবে থাকবে লাল কালো বর্ণের পদচিহ্ন
  • মিনারের পাশে থাকবে একটি জাদুঘর, পাঠাগার এবং সংগ্রামভিত্তিক  দীর্ঘ-দেয়ালচিত্র
  • মিনারের আশে পাশে থাকবে চোখের আকৃতির কিছু ঝর্না এবং এর প্রান্তীয় অংশে থাকবে ঢেউ খেলানো উঁচু বেদী
    ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে সামরিক আইন জারি হলে, শহিদ-মিনারের অসমাপ্ত কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৫ থেকে ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই অসম্পূর্ণ শহিদ-মিনারটিতেই ২১শে ফেব্রুয়ারিতে প্রভাতফেরি চালু ছিল।
   
১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নর লেফ্টেন্যান্ট জেনারেল আজম খান এই নকশার পরিবর্তন করার নির্দেশ দেয়। এর ফলে শহিদ মিনারটি একটি বিকৃত অবয়ব লাভ করে এবং এই বিকৃত নকশা অনুসারে ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে দ্রুত শহিদ মিনারটি শেষ করা হয়। এই বৎসরের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে এই নতুন শহিদ মিনারটি উদ্বোধন করেন  হাসিনা বেগম (ভাষা-শহিদ আবুল বরকত-এর মা)

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মার্চ দিবাগত রাত্রে গণহত্যা শুরু করে এবং শহিদ-মিনারটি ভেঙে ফেলে এবং সেখানে মসজিদের বিজ্ঞপ্তি টাঙিয়ে দেয়। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে  মসজিদের বিজ্ঞপ্তি সরিয়ে সেখানে নতুন শহিদ মিনার তৈরির পরিকল্পনা করা হয়। পুরানো নকশা অনুসারে নতুন শহিদ মিনার তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলেও ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে তাড়াহুড়ো করে নতুন শহিদ মিনার তৈরি করা হয়। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে শহিদ-মিনারের নতুন নকশা করা হয় এবং তা আর বাস্তবায়িত হয় নি। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে জেনারেল এরশাদের শাসনামলে এর প্রাঙ্গণের বিস্তার ঘটানো হয়। বর্তমানের শহিদ-মিনারটি অসমাপ্ত অবস্থাতেই রয়ে গেছে

No comments:

Popular